কবিতা লেখা ও না লেখা
অনেকেই আমরা মনে করি কবিতা
লেখাই সাহিত্যচর্চার সবচেয়ে সহজতম উপায়। তাই যতজন কবিতা লেখেন তার থেকে অনেক কম
সংখ্যক মানুষই গল্প উপন্যাস নাটক বা প্রবন্ধ লেখেন। এই যে একটি ধারণা, সেটি যে
সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মানুষের মন। ধরেই নেওয়া হয়,
কবিতা লেখা খুবই সহজ। তাই প্রায় সকলেই কবিতা লেখেন। এখানে অনেকের ভিতরেই মূল যে
ধারণাটি কাজ করে সেটি হলো, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় যতটা সময় দিতে হয়, কবিতা
লেখার কাজে ততটা সময় লাগে না। বরং অনেক কম সময়ে অনেক বেশি কবিতা লেখা যায়। আরও একটি
ধারণা মানুষের মনে ক্রিয়াশীল থাকে। সেটি হলো, একটি গল্প উপন্যাস বা নাটক লিখতে
গেলে যে অধ্যাবসয় ও পরিকল্পনা এবং সর্বপরি পরিশ্রমের প্রয়োজন, কবিতা লেখার বিষয়ে
সেগুলির কোনটিরই প্রয়োজন পড়ে না। গল্প উপন্যাস নাটকে একটি বা একাধিক প্লটকে নিয়ে
কাহিনীর বিস্তার, সংলাপের ভিতর দিয়ে নটকীয়তা গড়ে তোলা প্রভৃতি বিষয়গুলি স্বাভাবিক
ভাবেই প্রচুর পরিমানে ভাবনা চিন্তার দাবি রাখে। এবং পরিশ্রম সময় ইত্যাদির প্রয়োজন।
সেখানে কবিতা লেখার সময় এত কিছু শর্ত থাকে না। একটি প্রবন্ধ লিখতে গেলেও যে পরিমান
পড়াশুনা, ভাবনা চিন্তা ও সর্বপরি নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে গভীর ও স্বচ্ছ জ্ঞানের
দরকার, অনেকেরই ধারণা কবিতা লিখতে গেলে সেসব কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না। তাই কবিতা
লেখাই সবচেয়ে সহজ উপায় সাহিত্যচর্চার দিগন্তে। এমনটাই ভাবি আমরা
অধিকাংশ মানুষজন।
কিন্তু কি লিখি আমরা
কবিতায়? অধিকাংশ কবিতাই যদি আকার প্রকারের হিসাব দিয়েই কবিতা বলা যায়, তবে বলতেই
হয়; সেগুলির মাথামুণ্ডু কিছু থাকে না। অনেকটাই অসংলগ্ন প্রলাপের আক্ষরিক বিন্যাস মাত্র। অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই যেগুলিকে প্রেমের কবিতা বলে চালানো হয়ে থাকে। সেগুলিকে আলোচনার বাইরে
রাখাই শ্রেয়। সেসব বাদ দিয়েও যেগুলিকে অধিকাংশ মানুষ কবিতা বলেই ভুল করে বসে থাকে,
সেসব কবিতায় থাকেই বা কি? থাকে মূলত নির্দিষ্ট কোন ভাবনা বা ভাবনার বিস্তার। থাকতে
পারে নির্দিষ্ট কোন সমাজিক ঘটনা, বা ঘটনার প্রতিবাদ। থাকতে পারে ব্যক্তিগত
স্মৃতিরোমন্থন বা শোকগাথা। থাকতে পারে কাল্পনিক কোন গল্প বা সত্য ঘটনা। থাকতে পারে
নির্দিষ্ট কোন সমাজিক বা রাজনৈতিক বক্তব্য বা স্লোগান। থাকতে পারে নিষ্ফল মাথা
কুটে মরার ক্ষোভ বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ। এবং সেই সব লেখার ভিতর যেগুলির শব্দাবলিতে
আবৃত্তিযোগ্য বিন্যাস বিদ্যমান, দেখা যায় সেগুলিই সাহিত্য বাজারে বিখ্যাত হয়
সবচেয়ে বেশি। মানুষে ধারণায় সেগুলিই শ্রেষ্ট কবিতার তকমা পেয়ে যায় সহজে। এবং আরও
এলটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই পাঠক বা শ্রোতা হিসাবে কবিতার
ভিতর নির্দিষ্ট কোন গল্প বা কাহিনী এবং সুস্পষ্ট কোন বক্তব্যের সন্ধান করেন। ফলে
কবিতা লেখার সময়ও লেখকের ধারণাও সেই পথে এগোতে থাকে। একজন তথাকথিত কবি ও সাধারণ
পাঠক তখন সেই গল্প বা কাহিনী কিংবা নির্দিষ্ট বক্তব্যে এসে হাত ধরাধরি করে মিলে
যান। আর তখনই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন লেখক। সাহিত্যসমাজে তাঁর অটোগ্রাফের চাহিদাও তুঙ্গে
উঠে যায় তখনই। আর এইসব কারণেই অধিকাংশ সাহিত্যযশপ্রার্থীর ভাবনা চিন্তায় কবিতা
লেখাই সাহিত্যচর্চার সবচেয়ে সহজতম উপায় বলে মনে হতে থাকে।
না কবিতা আসলে এত সহজ সরল
সোজা কোন বিষয় নয়। আপনার ভাবনাগুলিকে শব্দের প্রাকারে ছন্দের বিন্যাসে বেঁধে
ফেললেই কবিতার সৃষ্টি হয় না। বস্তুত সাহিত্যচর্চার সবচেয়ে কঠিনতম মাধ্যমটিই হলো
কবিতা। গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ লেখা খুব কঠিন সন্দেহ নাই। সকলের কাজও নয়
এইগুলি। কিন্তু বিশুদ্ধ কবিতা লেখা সাহিত্যচর্চার সবচেয়ে কঠিনতম মাধ্যম। অধিকাংশ
সময়েই সেকথা স্মরণে থাকে না আমাদের। বা সেই সত্য সম্বন্ধে কোন ধারণাই থাকে না
আমাদের। আমরা ভুলে যাই, জগৎ ও জীবনের সাথে ব্যক্তি আমির অন্তরাত্মার সমন্বয়েরই আর
এক নাম কবিতা। সেই কবিতা আমরা লিখি আর নাই লিখি। অধিকাংশ মানুষের জীবনেই এই সমন্বয়
সাধনা সম্ভব হয় না। তাই অধিকাংশ মানুষই কবিতা থেকে চির নির্বাসিত। কিন্তু যাঁদের
জীবনে এই সমন্বয় সাধনা সম্ভব হয়, তাঁরা যদি কবিতা লেখার বিষয়ে এগোতে চান, বা এগোতে
থাকেন, কেবলমাত্র তখনই তাঁদের হাত ধরেই সৃষ্টি হতে পারে সার্থক কবিতা। কিন্তু কি
করে সম্ভব হবে এই সমন্বয় সাধনা? কবির কথার সূত্র ধরে এগোনো যেতে পারে। আকাশ ভরা
সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ। তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান। বিস্ময়ে তাই
জাগে আমার গান। হ্যাঁ এই গানই হোল সেই কবিতা। যার কথা বলতে চাইছি আমরা। কিন্তু এই
যে বিস্ময়, কখন জাগবে তা আমাদের মধ্যে? সে উত্তরও কবিই দিয়েছেন পরের লাইনেই; অসীম
কালের যে হিল্লোলে, জোয়ার ভাঁটায় ভুবন দোলে, নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান।
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান। না, দুঃখের বিষয় এটাই যে সাহিত্যবাজারের অধিকাংশ কবির
নাড়ীতেও রক্তধারায় সেই টান লাগে না। লাগে না ঠিক আমাদের সাধারণ মানুষজনের মতোই।
তাই তাদের হাত দিয়ে, কাহিনী বার হয়। বক্তব্য কিংবা প্রতিবাদী স্লোগান বার হয়।
কবিতার সৃষ্টি হয় না।
কিন্তু কেন লাগে না সেই
টান? আমাদের মতো অধিকাংশ সাধারণ মানুষের, বা সাহিত্যবাজারের অধিকাংশ
কাব্যবিক্রেতাদের? লাগবে কি করে? কারণটিও কবির কথার সূত্র ধরেই বোঝা যায়। কটি লাইন
পরেই কবি বলেছেন, কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি, জানার মাঝে অজানারে
করেছি সন্ধান, ……না আমরা সাধারণেরা কানও পাতি না। চোখও মেলি না। ধরার বুকে
প্রাণ ঢেলে অজনার সন্ধানও করি না, তাই আমাদের নাড়ীতে রক্তধারায় কোন টানই লাগে না।
যে টান না লাগলে বিস্ময়ে জাগে না কোন গান। যে গানই পারে সেই সমন্বয় সাধনা করতে, যে
সমন্বয় সাধনায় ব্যক্তি আমির অন্তরাত্মার সাথে এই জগৎ ও জীবনের সঠিক সমন্বয় সম্ভব।
যে সমন্বয় না হলে সম্ভব হয় না কবির জন্ম। যে সমন্বয় না ঘটলে সৃষ্টি হতে পারে না
বিশুদ্ধ কোন কবিতা। যে সমন্বয়ের অভাবে আমাদেরকে চিরনির্বাসিত থাকতে হয় বিশুদ্ধ
কবিতা থেকেই। অর্থাৎ আবহমান কালচেতনায় দীক্ষিত না হলে ব্যক্তি আমির গণ্ডী ছাড়িয়ে
অন্তরাত্মায় বিশ্ব-আমির সন্ধান না পেলে, প্রবাহমান সময়ে বিশ্বজগতে নিজের সঠিক
অবস্থান ও তার গুরুত্বই অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। আর হয় না বলেই জগৎ ও জীবন নিয়ে
আমাদের মনে কোন বিস্ময় জাগে না। যে বিস্ময় রক্তের ছন্দে ভুবনের ছন্দকে ধরতে পারে।
আর সেটি না পারলে হাজার
হাজার পাতার অক্ষর সাজিয়েও ছন্দ তাল ধ্বনির মাধুর্য্য বিস্তার করলেও সম্ভব নয় একটি
কবিতা লেখাও। মঞ্চ কাঁপানো আবৃত্তি শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করতে পারে সুসংবদ্ধ কাহিনীর
বিস্তারে। কিন্তু তা কখনোই কবিতা নয়। তা পাঁচালী হতে পারে বড়ো জোর। আসলে একজন কবি
প্রথমত একজন দার্শনিক। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে, অসীম ও সময় সম্বন্ধে, নিরন্তর
অনুসন্ধান ছাড়া দার্শনিক প্রত্যয় গড়ে ওঠে না। সেই প্রত্যয় ছাড়া কি করে সম্ভব হবে
কবিতার সৃষ্টি? তাই আজকের সাহিত্য বাজারে কবিতার এত হাহাকার। আজকের সাহিত্য বাজারে
কবি শিরোপাধারীর সংখ্যার কোন অভাব না থাকলেও বিশুদ্ধ কবিতার বড়ো অভাব।
তাই বলছিলাম কবিতা লেখা অত
সহজ নয়। কবিতা লেখা একমাত্র একজন কবির পক্ষেই সম্ভব। বাকিরা কবিতা না লিখেই কবিতার
আকারে শব্দাবলির পসরা সাজিয়ে বসে যান। কেউ সাহিত্য বাজারে, কেউ বা বন্ধুবৃত্তে।
যার যেমন সাধ্য ও সুযোগ। প্রায় সকলেই চিরনির্বাসিত রাখেন নিজেদের প্রকৃত কবিতা
থেকেই। আর এর বাইরে যিনি প্রকৃতই কবি, যিনি প্রকৃতই কাব্যসৃষ্টির ভিতর দিয়ে জগৎ ও
জীবনের সাথে ব্যক্তি আমির অন্তরাত্মার সমন্বয়ের সাধানায় ব্যপৃত, যাঁর নাড়ীতে
রক্তধারায় অসীম কালের হিল্লোল আর ভুবন দোলার টান লেগেছে; তিনি হয়তো আজ সকলের
অজান্তেই পড়ে রয়েছেন অপরিচিত হয়ে। কিন্তু মহাকাল ঠিক একদিন তাঁকে আবিস্কার করে
নেবে সময় মতন। যেদিন শিশিরের মতো নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাকিদের যাবতীয় কোলাহল।
৩১শে মার্চ ২০১৯
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
মন্তব্য
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন