বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সংকট
একটা সময় ছিল, যখন বাংলা আজ যা ভাবত,
ভারতবর্ষ তা ভাবত কাল । সে বাংলাও আজ আর নাই। সে সময়ও আজ আর নাই। যা পড়ে আছে তা খণ্ডবিখণ্ড
কয়েক টুকরো বাংলা। চলে যাওয়ার আগে ব্রিটিশ সেই বাংলার শিরদাঁড়াকে চিরকালের জন্যই ভেঙ্গে
দিয়ে গিয়েছে। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেই মস্তিষ্কের কোষে কোষে আজ ঘূণ ধরে গিয়েছে। কতটা
ঘূণ ধরে গিয়েছে, তার নমুনা দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলির কার্যক্রম ও তাদের নেতানেত্রীদের
ক্রিয়াকলাপে। দেখা যায় সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর নৈতিক অধঃপতনে। যারা ব্যক্তিস্বার্থ
চরিতার্থতায় ক্ষমতার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলদাসে পরিণত
হতেও দ্বিধান্বিত হন না কোনভাবে। লক্ষ্য একটাই যেভাবেই হোক ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজনৈতিক
শক্তির হাত ধরে যাবতীয় সুযোগসুবিধা আদায় করে নেওয়া। ফলে এঁদের পক্ষে স্ব স্ব রাজনৈতিক
শিবিরের স্বার্থ বিরোধী কোন অবস্থান নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। বরং রাজনৈতিক দলগুলির চুড়ান্ত
অনৈতিক ক্রিয়াকলাপকেও নিঃশর্তে সমর্থন করতে হয়। প্রচার করতে হয় মিথ্যাকে সত্যের মুখোশে
ঢেকে। না, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সকলেই যে নির্লজ্জ ভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের হয়ে
ওকালতি করেন, তাও নয়। সকলেই যে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের দলদাস হয়ে পড়েন তাও না। কিন্তু
অনেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। কোন বিতর্কে জড়াতে চান না। নিজের ব্যক্তিস্বার্থে
আঘাত না লাগা পর্য্যন্ত নিরবতার নিরাপদ খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন না। এদের বিশ্বাস একটিই,
সেটি হলো ‘বোবার শত্রু নাই’। বিপদে পড়লে এঁরাও প্রথমে কাঙ্খিত রাজনৈতিক শিবিরের ছত্রছায়া
খুঁজতে থাকেন। আপনি বাঁচলে বাপের নাম বলে।
খুব হাতে গোনা দুচারজনই থাকেন, যাঁরা এই দুই প্রজাতির বুদ্ধিজীবীর
মতোন নন। তাঁরা সাদাকে সাদা, আর কালোকে কালো বলেত দ্বিধা করেন না। কিন্তু মুশকিল হলো
একটিই তাঁরা সংখ্যায় এতই কম যে, তাঁদের কণ্ঠস্বর একেবারে সাধারণ জনতা অব্দি গিয়ে পৌঁছায়
না। মূলত নগর কলকাতা কিংবা রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক আঞ্চলিক বৃত্তেই আটকিয়ে থাকে। চিত্রটা
দুই বাংলাতেই একই রকম।
এই যে ঘূণে ধরা মস্তিষ্কের কথা বলছিলাম, এটি সম্ভব হয় তখনই
যখন একটি জাতি খণ্ডবিখণ্ড জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাতির সমগ্র অস্তিত্ব যখন ধরা
পড়ে না কোথাও, তখনই জাতি মধ্যমেধার কবলে পড়ে যায়। বাংলার অবস্থাও ঠিক তেমনই হয়েছে।
এবং সেই মধ্যমেধাই যখন খণ্ডবিখণ্ড জাতিসত্ত্বাকে নেতৃত্ব দিতে থাকে, মস্তিষ্কে ঘূণ
ধরে ঠিক তখনই। ১৯৪৭-এর বাংলাভাগের ফলে সমগ্র বাংলা আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক সীমানায় টুকরো
টুকরো হয়ে গিয়েছে। বাংলার একেবারে পশ্চিম ভাগের উত্তর অংশ ঢুকে গিয়েছে বিহার প্রদেশে।
পশ্চিমভাগের দক্ষিণ অংশের অনেকটাই আজ ঝাড়খণ্ডের ভিতর। বাংলার উত্তরের একটি অংশ পশ্চিম
আসামে, ও অন্য একটি অংশ দক্ষিণ পূর্ব আসামে পড়ে রয়েছে। একেবারে পূর্বদিকের অংশ ঢুকে
রয়েছে ত্রিপুরায়। ত্রিপুরা বাদে বাংলার এই অংশগুলি আজকে অবাঙালিদের দখলে। সেখানে বাঙালি
নিজভূমেই প্রবাসী হয়ে বসবাস করছে। একটি জাতির পক্ষে এর থেকে বড়ো দুর্ভাগ্য আর কি হতে
পারে? যে জাতি এই দুর্ভাগ্যকেও দুর্ভাগ্য বলে মনে করে না, সেরকম দুর্ভাগা জাতি বিশ্বে
আর কয়টি রয়েছে বাঙালি ছাড়া? ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভিতর ঢুকে থাকা বাংলার এই অঞ্চলগুলির
বাইরে যে বৃহৎ বঙ্গ, সেই বঙ্গই আজ পূর্বে বাংলাদেশ ও পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত হয়ে
পরস্পর বিদেশী সেজে পাশাপাশি পড়ে রয়েছে। এবং এইভাবে টুকরো টুকরো হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে
থাকা বাঙালি আজ আর নিজেকে সমগ্র বাঙালি জাতিসত্ত্বায় অনুভব করতেই পারে না। এই যে অক্ষমতা,
এই অক্ষমতা থেকেই মস্তিষ্কে ঘূণ ধরতে থাকে। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর সাত সাতটি দশক ধরে
এই ঘূণের বিস্তার ঘঠছে দ্রুতগতিতে। ফলে বাঙালির জাতিসত্ত্বাও আটকিয়ে গিয়েছে মধ্যমেধার
দিগন্তে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের জন্ম সেই দিগন্তেই। শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে
যাঁদের মেধা আজ আর কাজ করতে পারে না।
না একদিনেই এই অবস্থায় এসে পড়ে নি বাঙালি। দিনে দিনে ক্ষয়
হতে হতে তার চেতনা আজ প্রায় সম্পূর্ণই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাই এই অবস্থার বিষয়ে প্রায়
কোন বাঙালিরই কোন হেলদোল দেখা যায় না। কোন বুদ্ধিজীবীকেও চিন্তিত হতে দেখা যায় না।
ঠিক এইখান থেকেই বাংলার রাজনীতির হাল ধরে নেয় মেধাহীন পেশিশক্তি। সেই মেধাহীন পেশিশক্তির
দলদাসত্ব করে, নিজ নিজ ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার ভিতর দিয়ে মধ্যমেধার বুদ্ধিজীবীরা সমাজে
প্রতিপত্তি বিস্তার করতে থাকে। আর বাকিরা শামুকের মতো খোলসে সেঁধিয়ে নিজেকে নিরাপদ
রাখতেই ব্যস্ত থাকে। এই অবস্থা বিভিন্ন টুকরোয় বিভক্ত খণ্ড বিখণ্ড বাঙালি জাতিসত্ত্বার
বর্তমান পরিণতি। যে কারণে বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীরও কোন অভিন্ন জাতিসত্ত্বা গড়ে ওঠে
নি আজও। কেউ বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী, কেউ ভারতীয় বুদ্ধিজীবী হিসাবেই নিজের পরিচিতি অনুভব
করেন। কেউ মুসলিম বুদ্ধিজীবী কেউ হিন্দু বুদ্ধিজীবী হিসাবে গর্ব অনুভব করেন মনে মনে।
কেউ বা বিদেশে বসবাসের কারণে নিজেদের আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবী হিসাবে মনে করেন।
ভারতবর্ষের বর্তমান ঘটনাক্রম ও সেখানে বাঙালি বুদ্ধিজীবী
শ্রেণীর ভুমিকাকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে এই পরিণতিকে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়
বিজয়ী দলের সমস্ত চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে আজ আসমুদ্র হিমাচল ছাত্রসমাজ পথে নেমেছে।
এবং জনসাধারণের একটা বড়ো অংশই সেই ছাত্রসমাজের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতেও
যখন কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর নিরবতায় ছেদ পড়ে না, তখন বুঝতে হবে
মস্তিষ্কের ঘূণ কতদূর ব্যাপি পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মেধাবী
ছাত্রছাত্রীরা সরকারের ক্ষমতার আস্ফালনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখতে
আজ পথে নেমেছে। তাদের সোজা কথা। সংবিধান বিরোধী আইন প্রত্যাহার করতে হবে। ভারতবর্ষের
সংবিধান প্রদত্ত ধর্ম নিরপক্ষতার রক্ষাকবচ নষ্ট করা চলবে না। দেশের নাগরিকদের ভোটে
নির্বাচিত হয়ে নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া বা তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিভাজনে দেশের মানুষকে বিভক্ত করার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে।
খুব সহজ কয়েকটি দাবি। এই নিয়ে ধোঁয়াশার তো কোন বিষয় নাই। নাই বলেই সাধারণ জনতার একটি
বড়ো অংশের সমর্থন রয়েছে এই ছাত্রবিক্ষোভে। আর সেখানেই নড়েচড়ে বসেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক
দলগুলি। যে যার ভোট ব্যাংকের স্বার্থে জনতাকে বিভ্রান্ত করে নিজের ভোট ব্যাংক বাড়িয়ে
নিতে বা নিদেন পক্ষে ধরে রাখতে আদাজল খেয়ে পথে নেমে পড়েছে। রাষ্ট্রশক্তি তার সকল ক্ষমতা
প্রয়োগ করে ছাত্রসামাজকে দমিয়ে দিতে চাইছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শিবির ছলে বলে কৌশলে
ছাত্র আন্দোলনকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছে। আর সেই কাজে তারা ব্যবহার করতে চাইছে
দলদাস বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কেও।
সারা ভারতবর্ষ আজ এদের বিরুদ্ধেই গর্জে উঠছে। সেই গর্জনের
ঢেউ এসে লেগেছে পশ্চিমবঙ্গেও। এখানেও ছাত্রসমাজের একটা অংশ, বিশেষত কলকাতা কেন্দ্রিক
ছাত্রসমাজ সেই ঢেউতে সামিল হলেও কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজের শীতঘুম এখনো ভাঙেনি।
এখানে বুদ্ধিজীবীরা নিজ নিজ রাজনৈতিক শিবিরের রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে ট্যাঁ ফু করার
শক্তি রাখেন না। দল তাদের যে ভাবে পরিচালিত করবে, দম দেওয়া কাঠের পুতুলের মতোন তারা
সেই ভাবেই তোতাপাখির মতো দলীয় নেতানেত্রীদের বুলি আউরিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে
সামিল হবেন। আর রাজনৈতিক শিবিরগুলি তাদের ভোট ব্যাংক রাজনীতির স্বার্থে এইসব দলদাস
বুদ্ধিজীবীদের ঘাড় ধরে কাজ আদায় করে নেবে। নিচ্ছেও। তাই এঁদের কাছ থেকে জনগণের আশা
করার কিছু নাই। কিন্তু মুশকিল হল, এই দলদাসত্বের ঘরণার বাইরে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা
বুদ্ধিজীবীদের নিয়েই। তাঁরা এখনো নিজেদের শিরদাঁড়া বন্ধক না রাখলেও, সেটিকে সোজা করে
দাঁড় করাতেও পারেননি। পারলে, দেশের এইরকম সংকট কালেও তাদের পক্ষে নিরবতার নিরাপদ দূরত্বে
অবস্থান বজায় রাখা সম্ভব হতো না কোনভাবেই। আজ ভারতবর্ষের সংবিধান সুরক্ষিত রাখার, দেশের
ধর্ম নিরপেক্ষতার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার, দেশের সাধারণ নাগরিকদের নাগরিকত্ব সুরক্ষিত
রাখার এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে এই রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড়ো ভুমিকা
থাকার কথা ছিল। কিন্তু মধ্যমেধার এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী কোনদিনও সমষ্টির স্বার্থকে ব্যক্তি
স্বার্থের উপরে তুলে ধরতে পারেনি। তাই আজও পারছে না। মুখে কুলুপ এঁটে শীতঘুম দিচ্ছে
রীতিমত।
১৭ই জানুয়ারী ২০২০
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
মন্তব্য
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন